সিদ্ধিরগঞ্জ থানার তালিকাভুক্ত ও চিহ্নিত আসামিদের ছবি থানার বোর্ডের মধ্যে নাম দিয়ে বছরের পর বছর লাগানো থাকতে দেখা গেলেও হঠাৎ করে এক চিহ্নিত আসামির ছবি বোর্ডে না থাকায় এলাকাবাসীর মধ্যে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা ঝড়।
অন্যদিকে বিরাজ করছে সন্ত্রাসী হামলা ও মামলার আতংক। সাধারন মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে থানা পুলিশের উপর। এছাড়াও পুলিশের বিভিন্ন কর্মকান্ড নিয়ে দিন দিন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশের ভুমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সিদ্ধিরগঞ্জ থানার বোর্ডে কিশোরগ্যাং বাহিনীর লিডার, মাদক ব্যবসায়ীদের শেল্টার দাতা, হামলা, ভাংচুর, চাঁদাবাজী সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও হত্যা, ডাকাতি মামলাসহ একাধিক মামলায় পুলিশের তালিকাভুক্ত চিহ্নিত আসামি টাইগার ফারুক ওরফে চিকনা ফারুক এর ছবিটি ছিলো।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান, পিপিএমবার দায়িত্ব পালনকালে একাধিক মামলার আসামি ফারুককে চিহ্নিত করে এ-ই বোর্ডে ছবি লাগানো হয়। পাশাপাশি আরো অন্যান্য আসামিদের ছবিও রয়েছে।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় আগত সাধারণ মানুষ যেন অপরাধিদের চিহ্নিত করতে পারে এ উদ্দেশ্যেই সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় প্রবেশ মুখেই দেয়ালে বোর্ড স্থাপন করে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী, সাজাপ্রাপ্ত এবং দুর্ধর্ষ অপরাধীদের ছবি সাটানো হচ্ছে। এরফলে অনেক সাধারণ মানুষ এসব অপরাধি ও দুর্ধর্ষ লোকদের কাছ থেকে নিরাপদে থাকতে পারে।
অপরাধিরা যাতে নির্বিঘ্নে অপরাধ না করতে পারে মূলত থানা এলাকার লোকজনদের সচেতন করতেই থানা পুলিশের এ উদ্যোগ হলেও সম্প্রতি ওই বোর্ড থেকে চিহ্নিত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের ছবি নামিয়ে ফেলায় ব্যাপক সমালোচনা ও বিতর্কের মূখে পড়েছে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ।
অন্যদিকে পুলিশের এহেন কর্মকান্ডে আতংকে দিনাতিপাত করছে সাধারন মানুষ এবং সমাজে মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড নির্বিঘ্নে বেড়ে যেতে পারে বলে আশংকা করছেন সচেতন মহল।
সম্প্রতি সিদ্ধিরগঞ্জের আলোচিত চিহ্নিত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের ডজনখানেক মামলার আসামি টাইগার ফারুকের সাটোনো ছবি ওই বোর্ডে সরিয়ে ফেলায় থানা এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে অজানা আতংক, চলছে নানা সমালোচনা।
সাধারণ মানুষ বলছে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম মোস্তফা মোটা অংকের অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ছবিটি সরিয়ে ফেলেন। বেশ কিছুদিন টাইগার ফারুক থানার বোর্ড থেকে ওই ছবিটি সরানোর জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে তদ্ববির ও দেন দরবার করে আসছে।
এরআগেও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী মুক্তিনগরের বাসিন্দা নাজমা বেগমসহ কতিপয় অপরাধিদের ছবি ওই বোর্ড থেকে সরানো হয়ে বলে জানা গেছে। এ নিয়েও বেশ আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টিও হয়েছিলো।
সচেতন মহল বলছেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ওসি যোগ দেয়ার পর নানা অনিয়ম, মাদকসহ নানা অপরাধ বেড়ে গিয়েছে। মাসিক মাসোহারা দিয়ে বিভিন্ন অবৈধ কর্মকান্ডতে বৈধ বলে চালানো হচ্ছে। জ¦ালানী তেল, ভাঙ্গাড়ি ব্যবসা ও মাদক ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে মাসোহারা দিয়ে তাদের অবৈধ ব্যবসা জোরালোভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষ করে জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়ে দিনরাত চলে দেনদরবার। থানার দোতলাতেই যেন বিচারকের এজলাস বসে। এরপর শুরু হয় দফারফা। যে ওসির মনতুষ্ট করতে পারেন তার দিকেই ঝুঁকে দেয়া হয় বিচারের পাল্লা। এরপর ভুক্তভোগীরা ভয়ে কেউ আদালতে যাওয়ারও সাহস পায়না।
এভাবে অনেকেই ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে মুখবন্দ করে বুকে চেপে কষ্ট ধরে রেখে অপেক্ষা করছেন নতুন কোন কর্তা আসলে হয়ত ন্যায় বিচার পাবেনম অথবা আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন।
কে এই টাইগার ফারুক :ফারুক সাবেক আদমজী জুট মিলের শ্রমিক দলের সহ-সভাপতি আবু সাইদের বড় ছেলে। বর্তমানে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি পাগলাবাড়ী এলাকায় বসবাস করছে। তার এক ভাই পেশাধার ছিনতাইকারী, শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও একাধিক মামলার আসামি জসিম, অপর এক ভাই মহানগর ছাত্রদল নেতা জুয়েল। তার বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক, হামলা, ভাংচুর, চাঁদাবাজী, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, হত্যা ও ডাকাতি মামলাসহ একাধিক মামলা।
টাইগার ফারুক ও তার বাহিনীর কর্মকান্ড : চলতি বছরের ৭ এপ্রিল শুক্রবার রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলীর গ্যাসলাইন এলাকায় একটি বাড়ি ও দোকানপাট দখলকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটায় সন্ত্রাসী টাইগার ফারুক বাহীনি। সংঘর্ষের ঘটনায় টাইগার ফারুকসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা হয়।
হিরাঝিল এলাকার ইন্টারনেট ব্যবসায়ীর এক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে, সেই চাঁদাবাজির মামলায় গত ২ মে মিজমিজি এলাকায় অভিযান চালিয়ে চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী ফারুককে গ্রেপ্তার করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ। মামলায় চাঁদাবাজ ফারুককে প্রধান আসামি করে তার ভাই জসিম ও ফারুকের অপরাধ কর্মকান্ডের অপর এক অন্যতম সগযোগী বাবুকে ও আসামি করা হয়। পরে জেল খেটে পরে জামিনে বেরিয়ে আসে ফারুক।
গত বছরের ২৫ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জে নাসিক ১নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ার ইসলামের কার্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় টাইগার ফারুক মামলার প্রধান আসামি। এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পরে জামিয়ে বের হয়।
২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে সিদ্ধিরগঞ্জের চিটাগাং রোডে অবৈধ রেন্ট-এ কার স্ট্যান্ডের চাঁদাবাজি নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালত ‘ক’ অঞ্চলে দায়ের করা চাঁদাবাজি মামলার আসামি টাইগার ফারুক।
মামলা দায়ের করেন সিদ্ধিরগঞ্জের হিরাঝিল এলাকার মৃত হাজী আব্দুল মোতালেবের স্ত্রী মোসা: রহিমা বেগম (৬০)। তিনি সদ্য ভেঙ্গে দেয়া মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগের সহ-সভাপতি শিব্বির আহমেদের মা।
২০১৯ সালের ২০ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি আল আমিন নগর এলাকায় ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে বাক প্রতিবন্ধী সিরাজ নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে। সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পরে জামিনে বের হয়। এছাড়াও থানায় বিভিন্ন লিখিত অভিযোগও রয়েছে বলে থানা সূত্রে জানা যায়।
একাধিক সূত্র জানা যায়, এসব অপরাধীরা স্থানী ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় অসাধু ব্যক্তিবর্গের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে বীরদর্পে অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসব মাদক ব্যবসায়ী ও ছিনতাইকারী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই হামলার শিকার হতে হয় বলেও কেউ প্রতিবাদ করে না। উপর দিয়ে ফিট-ফাট ভিতর দিয়ে দলীয় ঘাট।
এসব সিন্ডিকেটের সদস্যদেরকে র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা বিপুল পরিমান মাদক সহ ছিনতাই, চাঁদাবাজী, হত্যা ও ধর্ষন মামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। তবুও থেমে নেই এই দূর্ধর্ষ সিন্ডিকেট সদস্যদের অপরাধ কর্মকান্ড।
প্রশাসনের নিরবতায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চিহ্নিত এসব মাদক ব্যবসায়ী, ছিনতাই, চাঁদাবাজ ও কিশোরগ্যায়ের বাহিনীরা। বিশেষ করে নাসিকের ১নং ওয়ার্ডে এই অপরাধীদের তৎপরতায় আতঙ্কিত।
টাইগার ফারুক ওরফে চিকনা ফারুকের অন্যান্য সহযোগী চলতি বছরের ৫ মে শুক্রবার দিনগত রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি টিসি রোডস্থ পূর্বপাড়া এলাকা থেকে মাদক চোরাকারবারির মূলহোতা জসিম সহ ৫ জনকে ৩০০ পিছ ইয়াবা ও ৩০ পুরিয়া হেরোইন সহ গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা ডিবি পুলিশ। পরে জামিনে বেরিয়ে আসে।
এরআগেও ছিনতাই করতে গিয়ে বিদেশী একটি চাকু (সুইচ গিয়ার) ও ছিনতাইকৃত দুটি মোবাইল ফোনসহ জসিমকে গ্রেপ্তার করেছিলো থানা পুলিশ।
নাসিক ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ার ইসলামের কার্যালয়ে হামলায় মামলার আসামী, নারী কেলেঙ্কারি, ধর্ষণের অভিযোগ, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মৃত সুন্দর আলীর ছেলে শরিফ এর বাড়িতে হামলা, ভাংচুর ও হত্যার হুমকির অভিযোগ, চাঁদাবাজী মামলাসহ বিভিন্ন অপরাধের মামলা রয়েছে এই পেশাদার ছিনতাইকারী ও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী জসিমের বিরুদ্ধে।
এছাড়াও হত্যা মামলার আসামি, কিশোর গ্যাং লিডার, বিভিন্ন অপরাধ ও অপকর্মে অভিযুক্ত বাবু ওরফে ফেন্সি বাবু। সিদ্ধিরগঞ্জের নাসিক ১নং ওয়ার্ড মিজমিজি পাগলা বাড়ি এলাকার কোমল বাস ড্রাইভার কুট্টি মিয়ার ছেলে বাবু।
গত ২ এপ্রিল-২০২১ সালে গভীর রাতে নয়াপল্টন এলাকায় একটি বিশেষ চেকপোষ্ট স্থাপনের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে টাইগার ফারুকের সহযোগী মাদক ব্যবসায়ী মিলন, তার ভায়রা মো. মোশারফ হোসেন ও সহযোগী মো. মহিন উদ্দিন হোসেন হƒদয়কে গ্রেপ্তার করে।
এসময় গ্রেপ্তারকৃত আসামীদের নিকট হতে ২০ কেজি গাঁজা, ১টি প্রাইভেটকার, ৩টি মোবাইল ফোন এবং ৪টি সীমকার্ড উদ্ধার করে র্যাব-৩ এর একটি দল।
গত ১৭ এপ্রিল রাতে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড় থেকে রাকিব, ওমর, সোলায়মান, ফরহাদ ও অয়নকে ৯৬ বোতল ফেনসিডিল ও ১৮ কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব-৩ এর সদস্যরা। এবং মাদকের কাজে ব্যবহৃত একটি প্রাইভেটকার জব্ধ করা হয়।
পরে উক্ত আসামিদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় হস্তান্তর করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত প্রত্যেকেই সিদ্ধিরগঞ্জ এলকার টাইগার ফারুকের মাদক সিন্ডিকেটের সদস্য বলে জনিয়েছেন এলাকাবাসী।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়- মুলত মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ভুমিদস্যু, তেল চোর, চিহ্নিত ছিনতাইকারী ও কিছু কিশোর-যুবকদের নিয়ে হামলা, ভাংচুর, চাঁদাবাজী সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সাবলীলভাবে চালিয়ে যেতে তৈরি করেছেন কিশোরগ্যাং বাহিনী। বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রনের জন্য একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে।
টাইগার ফারুক নিজেকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি মজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট লোক ও যুবলীগের কর্মী পরিচয় দিয়ে এবং দলীয় নাম ব্যাবহার করে এসব অপরাধসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে যাচ্ছে।
এছাড়াও টাইগার ফারুক মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে ইতিমম্যে বহুতল বাড়ি, গাড়ি ও বিপুল টাকার মালিক বনে গেছে। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগি মাদক ব্যবসায়িরাও প্রচুর টাকা ও গাড়ির মালিক।
অভিযোগ রয়েছে, তার মাদক সিন্ডিকেটের কোন সদস্য গ্রেপ্তার হলেই তাকে জামিনে বের করতে মুল ভুমিকা পালন করে টাইগার ফারুক। নামে বেনামে আরো অনেকেই।
এ বিষয়ে জানতে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম মোস্তফার মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে এসব অপরাধী ও অপরাধ কর্মকান্ড রূখতে নারায়ণঞ্জ জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ দাবি করছেন স্থানীয়রা।