নারায়ণগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মো. ওয়াজেদ সীমান্ত কে (২০) ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনায় দুই ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, এটা ছিনতাইয়ের ঘটনা। তবে এটাকি ছিনতাইয়ের ঘটনা নাকি পেছনে অন্য কোন রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল নিহত শিক্ষার্থী সীমান্ত। তার সাথে কারও কোন বিরোধ নেই বলে জানিয়েছেন নিহতের স্বজনরা। তবে শিক্ষার্থী সীমান্তের বাবা হাজী মো. আলম পারভেজ দীর্ঘদিন যাবত বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত রয়েছে। ফলে রাজনৈতির কোন প্রতিহিংসার বলি হতে হয়েছে কিনা তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সংশ্লিষ্টদের মনে।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ পাক্কারোড এলাকায় নিহত ওয়াজেদ সীমান্তর বাড়িতে তার স্বজনদের সাথে কথা হয়।
নিহত সীমান্তর মা রেহেনা আলম কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলে এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেল এ প্লাস পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ভালো ভলাফল করেছে। তহর কখুব মেধাবী ছাত্র। সে কখনো বাইরে যেতো না। বিশ্ববিদ্যালয় আর পড়াশোনা করে তার সময় কাটতো। বাইরে করও সাথে মিশতো না। তার কোন বন্ধু ছিলনা। সে সারাক্ষণ লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় তাকে আমরা বাইরে যেতে দেইনি। তবে আন্দোলনের মধ্যেখানে দু-দিন বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ছিল। সে সময় রাজধানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে আমার ছেলে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। তবে সেভাবে আন্দোলনে জড়ায়নি। পরবর্তীতে আমরা তাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করায় সে আর আন্দোলনে যায়নি। আমাদের একমাত্র আদরের ছেলে হওয়ায় তাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছি। এমনকি তার সাথে কারও কোন বিরোধ ছিলনা। এমন ভালো ছেলে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে এটা কখনো আশা করিনি। আমার ছেলে হত্যার সুষ্টু বিচার চাই।
ছেলের স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার ছেলে স্বপ্ন ছিল আমেরিকায় যাবে। সেখানে পড়াশোনা ও চাকরী করে সেটেল হবে। আর আমাদের সেখানে নিয়ে যাবে। আর টাকা জমিয়ে আমাকে হজে নিয়ে যাবে বলে জানিয়েছিল। প্রায় সময় হজে যাওয়ার কথা বলতো। সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলোনা।
বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও তার কোন শত্রু নেই উল্লেখ করে নিহত সীমান্তর বাবা হাজী মো. আলম পারভেজ বলেন, আমার ছেলে খুব সাদামাটা জীবন যাপন করতো। আমি তাকে রাজধানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত বাবদ মাত্র ২০৫ টাকা দিতাম। সে খুব মিশুক ছিল। তার সাথে কারও কোন বিরোধ ছিলনা।এমনকি আমার সাথেও কারও কোন বিরোধ নেই। কারণ আমি কখনো কারও ক্ষতি করিনি। যদি আমি সেই নব্বই দশক থেকে বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত রয়েছি। তবে বিএনপিতে আমার কোন পদ নেই। এই মামলায় পুলিশ যঠেষ্ট সহযোগিতা করেছে ও কাজ করছে।
এলাকাবাসী ও শান্ত নামে এক যুবক জানায়, সীমান্ত খুব ভালো ছেলে। তাকে এলাকার আড্ডায় কখনো দেখিনি। তাকে সব সময় মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দেখেছি। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সীমান্ত অংশগ্রহণ করেছে কিনা তা জানা নেই।
সীমান্ত হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সদর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. রফিক বলেন, এই মামলায় এখন পর্যন্ত দুজন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আসামি অনিক গ্রেফতারের পরে ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে কিভাবে নিহত শিক্ষার্থী সীমান্তকে ছুরিকাঘাত করেছে সেই বর্ণনা আমাদের কাছে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে হত্যা, ছিনতাই সহ ৮টি মামলা রয়েছে। পরে আকাশ নামে আরেক আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে হত্যা, ছিনতাই, চুরি সহ মোট ১১টি মামলা রয়েছে। তারা দুজনে আদালতে ১৬৪ ধারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্য আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
ঘটনাটি ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে ঘটনানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত যেটুকু পেয়েছি। তাতে করে পূর্ব কোন বিরোধ কিংবা অন্য কিছু পাইনি। এই ঘটনাটি শুধুমাত্র ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে ঘটনা হয়েছে।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্তি পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মাসুদ বলেন, গ্রেফতার আসামিরা জানিয়েছে, মানি ব্যাগ টানানানি নিয়ে এই ঘটনা ঘটেছে। গ্রেফতারকৃত ছিনতাইকারীরা ছিনতাইয়ের বিষয়ে প্রথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমাদের জানিয়েছে। ফলে এই ঘটনার সাথে পূর্ব কোন বিরোধের বিষয় এখন পর্যন্ত আমরা পাইনি।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) ভোরে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এআইইউবি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের ছাত্র ওয়াজেদ সীমান্ত তার দেওভোগের বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা হন। সকাল ৬টার দিকে বাড়ির পাশের ডিআইটি আলী আহাম্মদ চুনকা পাঠাগারের সামনে দুর্বৃত্তরা ওয়াজেদকে ছুরিকাঘাত করে। এ সময় তার কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন ও ১ হাজার ৮০০ টাকা লুট করে পালিয়ে যায়। গুরুতর আহত ওয়াজেদকে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। শনিবার রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওয়াজেদের মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় নিহত ওয়াজেদের বাবা মো. আলম পারভেজ বাদী হয়ে গত রবিবার নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে অনিককে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে লুট হওয়া মোবাইল ফোন এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি সুইচ গিয়ার চাকু উদ্ধার করা হয়। পরে আকাশ নামে আরও এক আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।