দীর্ঘ এক যুগ আগে এই দিনে (৮ মার্চ) মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর লাশ নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। আলোচিত সেই হত্যা মামলায় দীর্ঘ ১২ বছরেও চার্জশিট জমা দেয়নি তদন্তকারী সংস্থা র্যাব। তবে গত ৫ আগস্টের পরে হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১১। এতে নতুন করে আশার আলো দেখছেন নিহতের স্বজন সহ সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকালে সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী নিখোঁজ হন। এর দুই দিন পর ৮ মার্চ সকালে শীতলক্ষ্যা নদীর খালের পাড় থেকে পুলিশ ত্বকীর লাশ উদ্ধার করে। ওই রাতেই ত্বকীর পিতা বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় আসামি অজ্ঞাত উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন এবং ১৮ মার্চ জেলা পুলিশ সুপারের কাছে ত্বকী হত্যার জন্য এমপি শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, যুবলীগ নেতা জহিরুল ইসলাম ভূইয়া পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি রাজীব দাস, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান, সালেহ রহমান সীমান্ত ও রিফাত বিন ওসমান এর নাম উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অবগতি পত্র দেন।
তবে ২৪ মার্চ শামীম ওসমান সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ত্বকী নিখোঁজ ও লাশ উদ্ধারের সময়ে তিনি ও তার ছেলে অয়ন দেশের বাইরে ছিলেন।
ওই সময় অভিযুক্ত রিফাত বিন ওসমানকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তবে নিহতের পিতা রফিউর রাব্বির আবেদনে হাইকোর্টের নির্দেশে ওই বছরের ২০ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে র্যাবের কাছে মামলা হস্তান্তর করা হয়। র্যাব পরে ইউসুফ হোসেন লিটন, সুলতান শওকত ভ্রমর, তায়েব উদ্দীন জ্যাকি ও সালেহ রহমান সীমান্ত নামের চার জনকে গ্রেফতার করে। এ চার জনের মধ্যে ইউসুফ হোসেন লিটন ও শওকত হোসেন ভ্রমর আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরা সবাই এখন জামিনে আছেন।
ওই বছরের ৭ আগস্ট ওই সময়ের র্যাব কর্মকর্তা আরিফ হোসেন, এম এম রানাসহ র্যাবের কয়েকজন শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে আজমেরী ওসমানের মালিকানাধীন ‘উইনার ফ্যাশন’ এ অভিযান চালিয়ে রক্তমাখা জিন্স প্যান্ট, পিস্তলের বাট ও ইয়াবা সেবনের সরঞ্জামাদিসহ বিপুল পরিমাণ সামগ্রী উদ্ধার করে। অভিযানের সময়ে অফিসের দেয়াল, সোফা, আলমিরাসহ আসবাবপত্রে অসংখ্য বুলেটের দাগ পাওয়া যায়। আজমেরী ওসমান সাবেক এমপি শামীম ওসমানের ভাতিজা ও প্রয়াত এমপি নাসিম ওসমানের ছেলে।
২০১৪ সালের ৬ মার্চ তৎকালীন র্যাবের সহকারী মহাপরিচালক (এডিজি) জিয়াউল আহসান ঢাকাতে সংবাদ সম্মেলনে করে জানান, তদন্তে সন্দেহভাজন হিসেবে ওসমান পরিবারের সদস্য আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ত্বকী হত্যায় অংশ নেওয়া বাকি ১০ জন হলেন রাজীব, কালাম শিকদার, মামুন, অপু, কাজল, শিপন, জামশেদ হোসেন, ইউসুফ হোসেন ওরফে লিটন, সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর ও তায়েবউদ্দিন ওরফে জ্যাকি। কে কখন কীভাবে ত্বকীকে অপহরণ করে হত্যা করেছে র্যাব তার বর্ণনা দিয়েছিলেন। এরপর নাটকীয় ভাবে থমকে যায় মামলার তদন্ত।
এদিকে গত ৫ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর র্যাব আবার নড়েচড়ে বসে। আজমেরীর সহযোগী সাফায়েত হোসেন শিপন, মামুন মিয়া, আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে জামাই মামুন, কাজল হাওলাদার, আজমেরীর গাড়িচালক মোহাম্মদ জমশেদ ও পারভেজ গ্রেপ্তার হয়। এর মধ্যে মামুন মিয়া হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছে। বাকিরা জেলে। কাজল হাওলাদার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
ত্বকীর মামলার আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ বাবু বলেন, শুরুতে মামলার পুরো বিষয়টি থমকে যায়। এ কারণে ২০১৮, ২০২০, ২০২১ ও ২০২৩ সালে আদালতে দরখাস্ত দিয়েছিলাম যে, ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে যাদের নাম এসেছে তাদের দ্রুত গ্রেফতার এবং অভিযোগপত্র দাখিলে তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবকে নির্দেশ দেওয়ার জন্য। তখন আদালত তাগিদ দিলেও অভিযোগপত্র আজও দাখিল করেনি।
নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বলেন, ত্বকী নিহতের একবছরের মাথায় র্যাবের তদন্তে সব বেরিয়ে এসেছিল। ওসমান পরিবারের টর্চার সেলে ত্বকীকে কীভাবে হত্যা করে শীতলক্ষ্যায় লাশ ফেলেছে তা সবই সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল তৎকালীন র্যাব কর্মকর্তা। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে ওসমান পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা দিলে এই মামলার সব কার্যক্রম থমকে যায়। তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে এই মামলায় ৬ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। র্যাবের কর্মকাণ্ডে আমরা আশাবাদী।
তিনি আরও বলেন, ‘১২ বছর বিচারের জন্য অপেক্ষা করেছি। এখন তাড়াহুড়া করে ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগপত্র হোক, তা চাই না। আমরা সুষ্ঠু অভিযোগ পত্র চাই।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচএম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, মামলাটি আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখছি। এ মামলায় ৬জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ ঘটনায় ত্বকীর বাবার সাথে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। তিনিও আমাদের সহযোগিতা করছেন। তদন্ত শেষ হলে আমরা চার্জশিট দিয়ে দেব। তবে কবে নাগাদ মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে তা সুনির্দিষ্ট সময় বলা সম্ভব নয়।