১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে ঢাকা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে সেনা কর্মকর্তাদের এক অভিযানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ও প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হন। ঘটনার সময় তার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও ১০ বছরের শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ এবং কয়েকজন আত্মীয় নিহত হন। কেবল দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান।
হত্যাকাণ্ডের পর সেনা-সমর্থিত সরকার গঠন করা হয় এবং দেশজুড়ে সামরিক শাসনের অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫ আগস্টের এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বড় রাজনৈতিক মোড়বদল হিসেবে বিবেচিত হয়, যা দেশের রাজনীতি ও সমাজে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছরের আওয়ামী লীগ শাসনামলে বঙ্গবন্ধু কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একমুখী ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়। ১৫ আগস্ট তার হত্যাকাণ্ডের দিনকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করা হতো এবং আগস্ট মাসে ‘শোকের মাস’ হিসেবে মাসব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করা হতো। স্কুল-কলেজ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে এ বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরা হতো।
কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত এক বছরে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধু ও তার নেতৃত্ব নিয়ে ভিন্নধর্মী আলোচনা বেড়েছে। কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, নতুন প্রজন্মের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, স্বাধীনতা-উত্তর শাসনকাল এবং বাকশাল প্রতিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তারা বলছেন, অতিরিক্ত ব্যক্তিপূজা ও একপাক্ষিক ইতিহাস উপস্থাপন এ দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করেছে।
অন্যদিকে, অনেকের মতে, শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিস্মরণীয় স্থপতি, যার অবদান ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তি কল্পনা করা যেত না। ইতিহাসবিদরা বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব দুই দিকেই মূল্যায়ন করা যায়—একদিকে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক দক্ষতা, অন্যদিকে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে একদলীয় শাসন, অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক দমন-পীড়ন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বঙ্গবন্ধু নিয়ে এই দ্বিমুখী দৃষ্টিভঙ্গি আগামী দিনে আরও তীব্র হবে এবং বাংলাদেশের রাজনীতি, শিক্ষা ও গণমাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে ৩২ নম্বর ধানমন্ডি বাসভবন ভাঙচুর এবং সামাজিক মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নিয়ে আলোচনার পরিবেশ নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করেছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের আগে ভারতীয় ও আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থাগুলি তাঁকে সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের বিষয়ে সতর্ক করেছিল। তবে, তিনি এসব সতর্কতা উপেক্ষা করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে একদল সেনা কর্মকর্তা ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে হামলা চালিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করে। তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে, দুই পুত্রবধূ, ও অন্যান্য আত্মীয় নিহত হন। শুধুমাত্র দুই মেয়ে, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যান।
এই হত্যাকাণ্ডের পর আন্তর্জাতিক মিডিয়া গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত সাংবাদিক স্যার মার্ক টালি উল্লেখ করেন যে, এই অভ্যুত্থান আন্তর্জাতিক সমর্থন ছাড়া সম্ভব ছিল না। তিনি বলেন, “এই অভ্যুত্থান পরিকল্পনাকারীরা আন্তর্জাতিক সংযোগ গড়ে তুলেনি, তা অস্বাভাবিক।”
হত্যাকাণ্ডের পর সেনা-সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসে। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন এবং “ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স” জারি করেন, যা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের আইনি দায়মুক্তি প্রদান করে। ১৯৭৯ সালে এই আইনটি “ইনডেমনিটি অ্যাক্ট” হিসেবে সংসদে পাস হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এই আইনটি বাতিল করে।
বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তাঁর একদলীয় শাসনব্যবস্থা, বাকশাল প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ও অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে মনে করেন, ইতিহাসের একপাক্ষিক উপস্থাপন ও অতিরিক্ত ব্যক্তিপূজা এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে।
অন্যদিকে, অনেকের মতে, শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান স্থপতি এবং তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সমালোচনা থাকলেও, তাঁর নেতৃত্ব ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তি কল্পনা করা যেত না।
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর আন্তর্জাতিক মিডিয়া গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। ফরাসি দৈনিক লে মন্দে এই হত্যাকাণ্ডকে “একটি রাজতন্ত্রের পতন” হিসেবে বর্ণনা করে। অন্যদিকে, ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান উল্লেখ করে যে, “বাংলাদেশের ইতিহাস রক্তাক্ত অধ্যায় দ্বারা চিহ্নিত, যা জাতির ভবিষ্যতকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বর্তমানে, শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পেছনের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আন্তর্জাতিক শক্তির হাত ছিল। তবে, এই বিষয়টি নিয়ে এখনও স্পষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।